বারো মাস আগে জুলাইয়ের সেই ঐতিহাসিক দিনগুলিতে যখন ছাত্র-যুব সমাজ রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে এই আন্দোলন শুধু একটি বহু প্রতাপশালী স্বৈরাচারী সরকারের পতনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যদিও এর দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য নির্ভর করবে আগামী কয়েক মাসে দলটি কীভাবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তার উপর। “বর্ষা বিপ্লব”-এর নায়করা এখন জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে, এবং তাদের সামনে রয়েছে নিজেদের আদর্শ ও সক্ষমতার প্রমাণ দেওয়ার অগ্নিপরীক্ষা।
ঐক্য ও সাম্যের বার্তা
এনসিপি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে, তা হলো এর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র। একই মঞ্চে কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ, যা আমাদের ছোটবেলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন মতাদর্শের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি, নারী নেতৃত্বের অগ্রাধিকার – এ সব কিছুই ইঙ্গিত করেছে যে তাদের উদ্দেশ্য শুধুই আরেকটি রাজনৈতিক দল তৈরি নয়, বরং একটি নতুন ধরনের রাজনীতির সূচনা। একইভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে মঞ্চে নেতাকর্মীরা সবাই মাটিতে এক কাতারে বসেছিলেন; অতিথি এবং সাধারণ জনগণকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে তারা যেন প্রতীকীভাবে নিজেদের উপরে অবস্থান দিলেন এবং নিজেদের রাজনীতির চরিত্রকে অনন্যভাবে উপস্থাপন করলেন ।
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের দর্শন
তবে নিঃসন্দেহে সবকিছু ছাপিয়ে নাহিদ ইসলামের ঘোষিত দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ধারণাটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। সমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাহিদ ইসলাম যখন বললেন – “জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে” – এটি শুধু একটি গতানুগতিক রাজনৈতিক স্লোগানই নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি। আমেরিকায় উনিশশো শতাব্দীর গৃহযুদ্ধের পর যেমন দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের মাধ্যমে দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়ে নাগরিকত্বের নতুন সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফ্রান্সও পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়েছে, প্রতিটি সংকটের পর নতুন করে রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত এবং পুনর্গঠনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশও আজ তেমনি এক সন্ধিক্ষণে। ১৯৭১ সালে আমাদের প্রথম প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে, কিন্তু পরবর্তী পাঁচ দশকে তা ক্রমশ বিকৃত হয়ে পরিণত হয়েছিল দলীয় স্বার্থের হাতিয়ারে। আমাদের “প্রথম প্রজাতন্ত্র” তাই তার সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষ করে ফেলেছে। অর্ধ-শতাব্দী ঘুরে এখন সময় এসেছে একটি নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক চুক্তির, যা হবে সত্যিকার অর্থে সকল নাগরিকের জন্য, সকল নাগরিকের দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ, নাহিদের ভাষ্য মতে “জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র”। জুলাই বিপ্লব আমাদের সমাজের মৌলিক চরিত্রকে ঐতিহাসিক ভুলগুলোর আলোকে নতুন করে লেখার সুযোগ করে দিয়েছে ।
পারিবারিক রাজনীতির অবসান, যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্ব, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, এবং ভারত-বা-পাকিস্থানপন্থি রাজনীতির অবসান – এসব প্রতিশ্রুতি স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ। তাদের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র – যেখানে ক্ষমতার উৎস হবে জনগণ, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শাসকদলের বদলে নাগরিকের সেবা করবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে পৌঁছবে, এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বৈচিত্র্য হবে সার্বভৌম শক্তির উৎস – তা বাংলাদেশের একটি বড় অংশের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হতে বাধ্য।
সামনে অনেক পথ
তবে সামনের পথটি সহজ নয়। আওয়ামী লীগ ও ভারত এই তরুণ নেতৃত্বকে ইতিমধ্যেই তাদের পরম শত্রু মনে করে স্বাভাবিকভাবেই। বিএনপি, যাদের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই নতুন শক্তির উত্থানের ফলে, তারাও প্রতিটি ইঞ্চি রাজনৈতিক জায়গার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করবে। স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলা, নেটওয়ার্ক তৈরি, কর্মী বাহিনী গঠন – এসব ক্ষেত্রে বড় দলগুলোর চেয়ে পিছিয়ে থাকা নিঃসন্দেহে এনসিপি’র বড় দুর্বলতা।
ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে কুৎসা ও আক্রমণ। নাগরিক কমিটির এক নেতাকে তাঁর যৌন পরিচয়ের কারণে তীব্র আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে ব্যবহার করে দলকে অজনপ্রিয় করে তোলার প্রথম চেষ্টা। যদিও নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে লিঙ্গিয় বৈচিত্র সহ বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইতিমধ্যে দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা চাপের মুখে পড়ে ওই সদস্যকে অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা সহজ হবে না।
কেউ বলছেন এটি ইসলামপন্থী শক্তির ছদ্মবেশ, কেউ আবার অভিযোগ তুলছেন পশ্চিমা প্রভাবের। কোন কোন নেতার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই চাঁদাবাজির এবং অনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠছে। কিছু নেতার অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানও হয়ত একটা কৌশলগত ভুল ছিল, যার কারণে তারা অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ ও অজনপ্রিয় হয়েছেন। এসব ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে ও শুধরাতে হবে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, সৎ সাহস ও দূরদর্শিতার সাথে।
কেউ বলছেন এটি ইসলামপন্থী শক্তির ছদ্মবেশ, কেউ আবার অভিযোগ তুলছেন পশ্চিমা প্রভাবের। কোন কোন নেতার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই চাঁদাবাজির এবং অনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠছে। কিছু নেতার অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানও হয়ত একটা কৌশলগত ভুল ছিল, যার কারণে তারা অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ ও অজনপ্রিয় হয়েছেন। এসব ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে ও শুধরাতে হবে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, সৎ সাহস ও দূরদর্শিতার সাথে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখা। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, একক কারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ছাড়া দলগুলি প্রায়ই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান বা জিয়াউর রহমানের মতো শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে এনসিপি’কে তাই বিভিন্ন মতাদর্শের কার্যকর সমন্বয় ঘটাতে হবে, অভ্যন্তরীন গণতান্ত্রিক চর্চা করতে হবে, মূল আদর্শ ও বিশ্বাসের সাথে আপোষ না করেই।
কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য এনসিপির কাছে আছে অনন্য কিছু সুযোগ। প্রথমত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জুলাই বিপ্লবের সফল নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা এবং তুমুল জনপরিচিতি। ১৯৭১ সালের পর সম্ভবত এই প্রথম কোন রাজনৈতিক শক্তি এমন বিশাল জনসমর্থন নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। দ্বিতীয়ত, জেন-জি ও মিলেনিয়াল ভোটার (যাদের অনেকেই আসন্ন নির্বাচনে প্রথমবারের মত ভোট দেবে) এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমর্থন । এই নতুন প্রজন্ম পুরনো রাজনীতির কুটিলতা ও ঐতিহাসিক ব্যাগেজে আগ্রহী নয়, তারা চায় একটি আধুনিক, ভবিষ্যতমুখী এবং সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ।
তৃতীয়ত, এনসিপির নেতৃত্বের বৈচিত্র্য, তারুণ্য ও যোগ্যতা। ডঃ তাসনিম জারা’র মত অক্সফোর্ড-শিক্ষিত চিকিৎসক থেকে শুরু করে নাসিরউদ্দিন পটোয়ারী’র মত তৃণমূল সংগঠক – সবাই মিলে তৈরি করেছে একটি শক্তিশালী টিম। এই তারুণ্যে ভরপুর দলটির রাজনীতি শেখার সুযোগ ও সময় দুটোই যথেষ্ট রয়েছে, যদি তারা তাদের ইগো কে সামাল দিতে পারেন।
সময়ের পরীক্ষা
অবশ্যই শুধু ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। জাতীয় নাগরিক পার্টির কাহিনী শুরু হল মাত্র। এত সব কঠিন পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হতে পারবেন কিনা সময়ই বলে দেবে।
সফলতার জন্য প্রয়োজন শক্ত সাংগঠনিক ও মৌলিক কাঠামো, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও দক্ষ বাস্তবায়ন। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত না হতে চাইলে অবশ্যই এনসিপিকে তাদের মূল দর্শন – ন্যায়বিচার ও সমতা, সাধারণ নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান – এসবের প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত থাকতে হবে।
তবে যদি তারা তাদের জুলাইয়ের প্রত্যয়, সৎ সাহস ও ঐক্য ধরে রাখতে পারেন, এবং তাদের ঘোষণা অনুযায়ী মানুষের চাওয়া ও ইচ্ছাগুলোর প্রতিফলন তাদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে অচিরেই ক্ষমতায় না আসতে পারলেও বাংলাদেশের রাজনীতির মৌলিক চরিত্র এবং হিসাব নিকাশ চিরতরে বদলে দিতে পারবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
রুবাইয়াত খান মুক্তিপত্রের উপসম্পাদকীয় বিষয়ক সম্পাদক
Leave A Reply