বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে নতুন এক উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে— মোরাল পুলিশিং। একদল ব্যক্তি নিজেদের স্বঘোষিত নৈতিক অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে জনসাধারণ, বিশেষ করে নারীদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তারা নারীদের পোশাক, চলাফেরা, সামাজিক আচরণ ও ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর অযাচিত মন্তব্য করছেন, কখনো কখনো শারীরিক বা মানসিক হেনস্তার পথও বেছে নিচ্ছেন। এই প্রবণতা শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপই নয়, বরং এটি সামগ্রিকভাবে সমাজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে গ্রেপ্তার করা হয়। অর্ণবের মুক্তির দাবিতে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে পরিচিত একদল ব্যক্তি শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেন, যা দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন ভুক্তভোগী ছাত্রী ফেসবুকে একটি পোস্টে জানান, শাহবাগ থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে অর্ণব তাকে থামিয়ে তার পোশাক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। তিনি উল্লেখ করেন, “সে আমাকে হুট করে রাস্তায় দাঁড় করায় দিয়ে বলতেছে আমার ড্রেস ঠিক নাই, আমি পর্দা করি নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি এবং তার আচরণ খুবই অ্যাগ্রেসিভ ছিল।” এই পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
ভুক্তভোগী ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দায়ের করেন, যেখানে অভিযুক্ত অর্ণব হেনস্তার বিষয়টি স্বীকার করেন। পরে তাকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। অর্ণবের গ্রেপ্তারের পর, ‘তৌহিদী জনতা’ নামে পরিচিত একদল ব্যক্তি রাত থেকে শাহবাগ থানার সামনে জড়ো হয়ে তার মুক্তির দাবিতে অবস্থান নেন। তাদের দাবি ছিল, অর্ণবকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান চালিয়ে যাবেন।
মোরাল পুলিশিং কী এবং কেন এটি উদ্বেগজনক?
‘মোরাল পুলিশিং’ বলতে বোঝায়— একটি দল বা গোষ্ঠী যখন নিজেদের নৈতিকতার মাপকাঠি দিয়ে অন্যদের আচরণ যাচাই করে এবং জোরপূর্বক তাদেরকে সেই মানদণ্ডে চলতে বাধ্য করে। এটি রাষ্ট্রীয় আইন নয়, বরং একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাপ, যা ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নারীদের পোশাকের ধরন, চলাফেরার পদ্ধতি, এমনকি তাদের ধূমপান করার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন এবং প্রকাশ্যে অপমানজনক মন্তব্য করছেন।
এই প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ এটি নারীদের আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করে, পাশাপাশি সমাজে ভয়ভীতি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের নৈতিক অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, তাহলে সেটি ক্রমশ সহিংসতার দিকে যেতে পারে।
নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানানো: পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিফলন
বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বিরাজমান। নারীদের কী করা উচিত, কী পরিধান করা উচিত, কোথায় যাওয়া উচিত—এসব বিষয়ে সমাজের একাংশ সবসময়ই ‘পরামর্শ’ বা ‘নির্দেশনা’ দিয়ে এসেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই মনোভাব আরও উগ্র হয়ে উঠছে এবং সেটি প্রকাশ্যে হেনস্তার রূপ নিচ্ছে।
মেয়েদের যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার থাকে, তবে তাদের পোশাক বা অভ্যাস নিয়ে অন্য কেউ সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার রাখে না। কিন্তু মোরাল পুলিশিংয়ের মাধ্যমে নারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা আসলে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য বজায় রাখারই আরেকটি কৌশল।
মোরাল পুলিশিংয়ের সামাজিক প্রভাব
মোরাল পুলিশিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব অনেক গভীর।
প্রথমত এটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কী পরিধান করবে, কীভাবে চলবে, তা নির্ধারণের অধিকার তার নিজস্ব হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, এটি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এই ধরনের প্রবণতা ক্রমশ সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়। কেউ যদি কথার মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে না পারেন, তবে তারা শারীরিক নির্যাতনের পথ বেছে নিতে পারেন।
মোরাল পুলিশিং আইনের শাসনের দুর্বলতার পরিচায়ক। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন নিজেদের নিয়ম অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তখন তা রাষ্ট্রীয় আইনের শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
মোরাল পুলিশিং নারীদের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করে। নারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল বা সামাজিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়, যা তাদের বিকাশের পথে বড় অন্তরায়।
মোরাল পুলিশিং প্রতিরোধে করণীয়
মোরাল পুলিশিং বন্ধ করতে হলে সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে, জনসাধারণের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। হেনস্তাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে এবং এ ধরনের আচরণ যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, তা বোঝাতে হবে।
প্রতিবাদী কণ্ঠকে জোরালো করতে হবে, যেকোনো ধরনের মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হলে চুপ না থেকে সোচ্চার হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এই ইস্যুগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন।
শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিকতা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে, লিঙ্গসমতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও মুক্তচিন্তার হয়ে ওঠে।
নারীদের আত্মবিশ্বাস ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, নারীদের নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং হেনস্তার শিকার হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোরাল পুলিশিং একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে যায়। এটি যদি এখনই রোধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে আরও চরমপন্থী ও সহিংস রূপ নিতে পারে। সমাজকে নারীদের চলাফেরা, পোশাক কিংবা আচরণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বদলে, তাদের সমান অধিকারের সুযোগ দিতে হবে।
মোরাল পুলিশিং একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে যায়। এটি যদি এখনই রোধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে আরও চরমপন্থী ও সহিংস রূপ নিতে পারে। সমাজকে নারীদের চলাফেরা, পোশাক কিংবা আচরণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বদলে, তাদের সমান অধিকারের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র আইনি ব্যবস্থা নয়, বরং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েই মোরাল পুলিশিং বন্ধ করা সম্ভব।
অপরাজিতা দেবনাথ ঢাকা জজ কোর্টের একজন এডভোকেট
Leave A Reply