বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দলবাজ, দলীয় নিয়োগ প্রাপ্ত। প্রায় সবার বিরুদ্ধেই কম বেশি দুর্নীতি ও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। দলীয় গণ্ডীর বাইরে এই মুহুর্তে দেশের কোন সম্মানিত ও সজ্জন শিক্ষাবিদ একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও উপাযার্চ পদ অলংকৃত করছেন না। প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় শিক্ষাগত নাহয় পরিচালনাগত অচলাবস্থা কমবেশি বিরাজমান। দলবাজ প্রশাসন গুলো অপব্যবস্থাপনা জাত অচলাবস্থা, আর্থিক ও নিয়োগ জালিয়াতি এবং শিক্ষাদানের ফাঁকি গুলো জারি রেখে শিক্ষালয়ে শুধু অজ্ঞানতার অন্ধকারকেই বর্ধিত করে চলেছে। দলীয় ছাত্ররাজনীতির মারমুখী পান্ডাদের যোগসাজশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা ও উন্নয়ন বরাদ্দ লুটে নেয়াই দলীয় উপাচার্য, উপাচার্য অনুগত তোষামুদে দলবাজ শিক্ষকদের মূল কাজ হয়ে উঠেছে। ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির ক্ষমতালিপ্সু কলঙ্কিত হাত ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো শুধুই অপরাধ তৈরির স্থান হিসেবে অবির্ভুত হয়েছে।
এমতাবস্থায় আমরা দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক পরিসরের প্রথম এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়নি। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রতি বছর সারাবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং প্রকাশ করে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এক হাজারের পরে থেকেছে। সাময়িকীটির বরাত দিয়ে বিবিসি’তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারাবিশ্ব থেকে ৯২টি দেশের ১৩শ’ বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবারের তালিকায়। তাতে একমাত্র বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্থান হয়েছে। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো ছয়শ’ থেকে আটশ’র মধ্যে। কিন্তু এর বছর দুই পরেই এটির অবস্থান নেমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মানের এই ক্রম অধঃপতন ভীতি জাগানিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা অপব্যবস্থাপনা, ক্ষমতাবলয়ের মদতপুস্ট ছাত্র সঙ্ঘঠনের একের পর এক কেলেঙ্কারি, প্রশাসনের আর্থিক দুর্নীতি ও নিয়োগ জালিয়াতি এবং শিক্ষা বাণিজ্যিকিকরণের ঝোঁক সব মিলে মানের এই অধোগতি বিচ্ছন্ন কিছু নয়।
শিক্ষাঙ্গনে তেলবাজ ও লুটেরা দলীয় প্রসাশক নিয়োগ দিয়ে, নোংরা শিক্ষক রাজনীতি পুষে বিশ্বিবিদ্যালয়ের ফান্ড লুট করার, বিশ্ববিদ্যালয়কে একক সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখার অপচেষ্টা গুলো এখনই থামাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের উপাচার্য নিজেকে নিয়োগের ক্ষমতা দিতে হবে, যেখানে শ্রেণীকক্ষে প্রদত্ত লেকচারের গুণগত মান, শিক্ষাদান পদ্ধতির মান, ছাত্র ছাত্রী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়নে প্রাপ্ত স্কোরের গড়, গবেষণা গত অর্জন, আন্তর্জাতিক জার্নাল প্রকাশ, আন্তর্জাতিক গবেষণা স্বীকৃতি ইত্যাদি প্রাধান্য পাবে। এই বহুবিধ স্কোরিং একজন সম্মানিত ও নিবেদিত শিক্ষককে উপাচার্য হতে এগিয়ে রাখবে। ফলে গভীরভাবে শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থাপনায় সংযুক্ত ও নিমগ্ন শিক্ষক উপচার্য হতে উঠতে পারবেন। নিয়োগ ও পদায়নে গবেষণাকে প্রাধান্য দিলে দলীয় লেজুড়বৃত্তির সংস্কৃতি উপড়ে ফেলা সহজতর হবে। উপাচার্য পদটিকে রোলিং হতে হবে এবং সিনিয়রিটি ভিত্তিক স্কোরিং নির্ভর পদায়নকে প্রাধান্য দিতে হবে। দলীয় নিয়োগের লাগাম টেনে ধরে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
শিক্ষকদের কুৎসিত ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতি বহাল রেখে, ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক নিয়ন্ত্রণে রাখার ঘৃণ্য খোলস না বদলালে কোন অর্জনই আর ধরা দিবে না। আজকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কোন ধরনের গবেষণা না করেই লোকে অধ্যাপক বনে যাচ্ছেন। একদিকে মেধাহীন ছাত্র দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে, অপরদিকে নিয়োগ পরবর্তিতে পাচ্ছে গবেষণাহীন প্রমোশন। এভাবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো মানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করতে নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ। ফলে বেশ কিছু মানবসম্পদ বিভাগে চাকুরির বাজার চাহিদা থাকলেও উচ্চ নম্বরধারী বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকগণ সেসব পদে কাজ করার যোগ্যতা রাখেন না, একদিকে শিক্ষা মান ও শিক্ষক মান উভয়ের নিচুতার কারণে অন্যদিকে শিক্ষার কনটেন্টে পশ্চাৎ পদতার কারণে, শিক্ষার কন্টেন্টের সাথে ইন্ডাস্ট্রির হিউম্যান রিসোর্স ও স্কিল সেট ডিমান্ডের সমন্বয়হীনতার কারণে। ফলে প্রচুর বিদেশী নাগরিক দেশের অভ্যন্তরীণ চাকুরির বাজারে প্রবেশ করছেন যেখানে দেশেরই ৪৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত বেকার পড়ে থাকছেন।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের সাথে দেশের মানুষের সমস্যা ও সংকট সমাধানের, দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার, বহুবিধ ইন্ডাস্ট্রির কারিগরি উতকর্ষ বুঝার এবং ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা সমাধানের হেতু তৈরির কোন সম্পর্ক নেই। যারা এই সম্পর্ক গুলো তৈরি করে সংকট সমাধান এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবেন, সে শিক্ষকেরাই শিক্ষা ও গবেষণা কাজ পাশ কাটিয়ে কুৎসিত দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে গবেষণা ছাড়াই পদ পদবি বাগাতে ব্যস্ত, বিশ্বিবদ্যালয়ের ফান্ড হাতাতে ব্যস্ত। ফলে ক্লাসে তারা মান সম্পন্ন শিক্ষাদানে ব্যর্থ। ইনারা বছরের পর বছর গাল গল্প করে শ্রেণীকক্ষে সময় ক্ষেপণ করেন, নিন্মমান ও পশ্চাৎপদ সিলেবাস পড়িয়ে, বার বারের পুনরাবৃত্ত কাট কপি পেস্ট মানহীন গবেষণা করিয়ে, লেকচার নিবার প্রাক প্রস্তুতিহীনতায় থেকে যুগ যুগের পুরানো চোথা পড়িয়ে দিন পার করছেন। এভাবে শ্রেণীশিক্ষা দান চলতে পারে না।
ফলে সময় হয়েছে ইন্ডাস্ট্রি স্কিলের চাহিদা কেন্দ্রিক বিষয়বস্তু ও কোর্স কারিকুলাম সাজানোর। সময় হয়েছে বাধ্যতামূলক শ্রেণীশিক্ষক মূল্যায়ন চালু করার, সময় হয়েছে বহিরাগত শিক্ষক দিয়ে প্রশ্ন পত্র তৈরি করার, সময় হয়েছে দৈবচয়নে বহিরাগত শিক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করার। সময় হয়েছে শ্রেণীকক্ষ পাঠদানকে ভিডিও’র আওতায় এনে ক্লাস লেকচারের মান যাচাই করার। শিক্ষকদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক যে কোন পদায়নে এই স্কোরগুলোকে সমন্বিত করে তবেই এডমিনিস্ট্রেশন প্রসেস, প্রশাসনের পদায়ন এবং নিয়োগ ব্যবস্থা সাজাতে হবে। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষকদেরকে কম্ফোর্ট জোন থেকে বের করে আনতে হবে এবং অধিক পরিমাণে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করার স্থায়ী প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে যাতে তারা শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা সুযোগ না পান এবং দরকারও না পড়ে।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের উপাচার্য নিজেকেই নিয়োগের একক ক্ষমতা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্বশাসিত, ফলে উপাচার্য শুধু নয়, আচার্য নিয়োগও বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ার ভুক্ত হওয়া উচিৎ। কেন এবং কোন শিক্ষাগত যোগ্যতায় একাডেমিক শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে অযাচাইকৃত যোগ্যতার, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কহীন একজন রাজনৈতিক নেতা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হবেন? আচার্য দলীয় বলে কেন্দ্রীভূত অনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো দলীয় উপাচার্যও খোঁজে এবং বরাবর এই দলীয় নিয়ন্ত্রণের পথেই উপাচার্য নিয়োগ দেয়। এই দলীয় নিয়োগ বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, নিন্মমান শিক্ষা, গবেষণাহীনতা, অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা ও সার্বিক অচলাবস্থার জন্য দায়ী। কেননা এই পদ্ধতিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় নিয়ন্ত্রণ ও দলীয় লুটতরাজ নির্বিঘ্ন থাকে।
দেশে বহু বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় নিজের উপাচার্য নিজে নিয়োগের একক ক্ষমতার চর্চা শুরু করতে পারলে প্রকৌশল ও কারিগরি, লিবারেল আর্টস কিংবা বিজনেস ডোমেইনের আন্তর্জাতিক দিকপাল, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একাডেমিশয়ান, প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী, এমিরেটাস অধ্যাপক, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ কিংবা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বনামধন্য শিক্ষালয়ের সাবেক উপচার্যদের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দানের পথ সুগম হবে। এতে করে শিক্ষালয়ে গুণগত মান (এক্সিলেন্স) আসার একটা পথ তৈরি হবে। লাল নীল সাদা বেগুনী বর্ণের কুৎসিত শিক্ষক রাজনীতি করা কথিত শিক্ষাবিদেরা উপাচার্য হয়ে কিছুই দিতে পারছেন না, বরং উনারা পাপাচার্যই থেকে যাচ্ছেন, এবং সর্বক্ষেত্রে নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে না আসছে ভালো র্যাংকিং, না পাচ্ছে আমাদের ছেলে মেয়েরা দলীয় নির্যাতন থেকে মুক্তি। অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থাগত বিষয়গুলো হয়ে উঠছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।
ইতিহাস অতীতের জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ও জ্ঞান পুনঃ উৎপাদনের পাশাপাশি বর্তমানের ও ভবিষ্যতের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কারিগরি জ্ঞান ও উতকর্ষ, আধুনিক শিল্প ও বাজার ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক ও টেকসই সমাজ ব্যবস্থাপনার সমস্যাবলীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমন্বিতভাবে সংযুক্ত করার মত যোগ্যতা সম্পন্ন প্রশাসক বা উপাচার্য দরকার আমাদের শিক্ষালয় গুলোতে। আমাদের আর উপাচার্য নামক দলীয় পান্ডা’র প্রয়োজন নেই।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব একজন টেকসই উন্নয়ন কর্মী। তার সাথে যোগাযোগ করুন এই ঠিকানায়— Faiz.taiyeb@gmail.com