কিছুদিন আগেই, কোটা আন্দোলনের সময়কার কথা। এক ছেলে তার সাদা টিশার্টে লিখেছিল “আমি রাজাকার”। মূহুর্তেই তার ছবি ভাইরাল হয়ে যায়, কারো কাছে ঘৃণার বস্তু আর কারো কাছে প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে। যার কথার প্রেক্ষিতে ছেলেটি টিশার্টে “আমি রাজাকার” লিখেছিল- পরেরদিন’ই কোটা আন্দোলনকারীরা তাঁর নামে শাহবাগে স্লোগান তোলে – ম-তে – মতিয়া…
২০১৩ সালের গণজাগরণ নিয়ে টুকটাক খবর রাখা লোকটিও জানেন এই ম-তে-মতিয়া দিয়ে আসলে কি বুঝাতে চাওয়া হয়েছে। শেষপর্যন্ত ছেলেটির টিশার্ট, তার প্রতিবাদের ধরণ এবং সে ঘৃণার পাত্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমকালে।
আমাদের পত্রপত্রিকায়, ব্লগ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঐ টিশার্ট নিয়ে যেই কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছিল তা হচ্ছে- “আমি রাজাকার” এইটা কখনো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না”।
এই ব্যাপারে আমাদের প্রজন্মের বুদ্ধির সবচেয়ে বড় বাতিঘর – অধ্যাপক জাফর ইকবাল লিখেছিলেন,
“আমরা যারা ১৯৭১ দেখেছি তাদের কাছে রাজাকারদের চাইতে ঘৃণিত কোনো প্রাণী আছে বলে মনে করতে পারি না। রাজাকারেরা নিজেরাও সেটা জানতো, তাই তারাও যে খুব বড় গলায় গর্ব করে বুকে থাবা দিয়ে “আমি রাজাকার” বলে বেড়িয়েছে সেরকম মনে করতে পারি না।
তাই ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে যখন দেখি একজন ছাত্র নিজের বুকে “আমি রাজাকার” কথাটি লিখে গর্বভরে দাড়িয়ে আছে আমি সেটি বিশ্বাস করতে পারিনি। মাথায় আগুন ধরে যাওয়া বলে একটা কথা আছে, এই কথাটির প্রকৃত অর্থ কী আমি এই ছবিটি দেখে প্রথমবার সেটি অনুভব করেছি।”
কিন্তু অধ্যাপক জাফর ইকবাল এইখানে কিঞ্চিৎ মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন আরকি!
নব্বইয়ের দশকের শুরুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধান কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন –
“হে পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক,
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন।”
কবিতাটির নাম ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা তৎকালীন সময়ের একটি আলোচিত কবিতাও বটে।
কবিতাটা এতই আলোচিত ছিল যে এটি প্রকাশের পর যায়যায়দিন-এ ‘কবির লড়াই’ শিরোনোমে শামসুর রাহমানের কবিতার জবাব দেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
সুতরাং রাজাকার হবার আকাঙ্ক্ষার কথা অধ্যাপক জাফর ইকবাল আগে শোনেনি তা আর বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু তখন অধ্যাপক জাফর ইকবালের মাথায় আগুন ধরে যাওয়া অনুভব হয়নি। কেন হয়নি সেটা বলছি।
আপনার পরিচিত ডাক্তার যখন আপনাকে পোষাক খুলে নগ্ন হতে বলছে তার সামনে, ব্যাপারটা আপনি স্বাভাবিক ভাবেই নেন সাধারণত, মনে করেন সেটা তার ডিউটি, আপনাকে রোগ মুক্তি দেবার প্রক্রিয়ার অংশ সেটা।
কিন্তু একই প্রস্তাব যখন আপনার অপরিচিত কেউ করে, তখন ব্যাপারটা আপনার কাছে যৌন হয়রানি। সেটাও স্বাভাবিক। তবে মজার ব্যাপার কি জানেন!
মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় আমাদের প্রচন্ড আক্ষেপের সাথে পড়তে হয় – ডাক্তারের যৌন লালসার শিকার রোগী টাইপ শিরোনাম গুলো। বাট স্টিল, সেম সিচুয়েশনে উই চুজ টু বিলিভ, যেহেতু আমরা ডাক্তার হিসেবেই চিনি ডাক্তারকে, যৌন লোলুপ হিসেবে না।
এবং অপরিচিত লোকটা একই প্রস্তাব করলে, এমনকি সে যদি মহান কোনো উদ্দেশ্য থেকেও করে থাকে, তাও- উই চুজ টু রিয়্যাক্ট।
যেহেতু আমরা চিনিই না তাকে।
অধ্যাপক জাফর ইকবালের কাছেও শামসুর রহমানের কবিতা একজন ক্ষুব্ধ কবির প্রতিবাদ ছিল, যেহেতু সে তারে চেনে, জানে তার পলিটিকাল আইডেন্টিটি, বিশ্বাস করে, এবং জানে যে নিজেদের লোক।
কিন্তু ‘আমি রাজাকার’ লেখা টিশার্টের ছেলেটির বেলায় তিনি জানেন না। জানেন না তাঁর পলিটিকাল আইডেন্টিটি কি! সে কি ‘আমি রাজাকার’ বলে নিজের চিন্তার আত্মপ্রকাশ করলো সুযোগে! নাকি সেটা ছিল নিতান্তই একটা সাধারণ প্রতিবাদ। এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমার নিজের’ও জানার সুযোগ নাই। আমি যদি সেই ছেলেরে গিয়ে জিজ্ঞেসও করি, তবুও ব্যাপারটা শিওর হওয়া যাবে না যে ছেলেটা যা স্বীকারোক্তি দেবে তা’ই সত্যি।
তো অধ্যাপক জাফক ইকবালকে মিথ্যুক প্রমাণ করা বা তার ফেলাসি নিয়ে আলাপ করা কিংবা সেই ছেলেটার প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে কথা বলা এই পোস্টের উদ্দেশ্য না।
এই কথা গুলো ভূমিকা হিসেবে বলা, এইবার আসল আলাপে আসি।
এইযে “শিবির-রাজাকার-জামাত”, এই শব্দ গুলোর মতো ভয়াবহ আতঙ্কজনক শব্দ এতো সস্তা হলো কি করে যে রাস্তাঘাটে ছেলেপেলে ‘আমি রাজাকার’ গায়ে লিখে ঘুরে বেড়াতে পারে?
উত্তরটা আপনারা জানেন, ২০১৪ সালে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিজেদের ফ্যাসিবাদ পাকাপোক্ত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলীয় লোকজন প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমত হিসেবে যখন যাকে সামনে পেয়েছে তাকে ঘায়েল করতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে জামাত শিবির নামক স্পর্শকাতর ট্যাগের তাকমা। ফলশ্রুতিতে দিনদিন পরিস্থিতি এতোটা দুঃখজনক হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দেশে স্বাধীনতার পক্ষের লোকের চেয়ে আওয়ামী ফিল্টারে আওয়ামীলীগের বাহিরের সবাই অর্থাৎ দেশের সিংহভাগ মানুষই হয়ে গেছে জামাত শিবির রাজাকার। কখনো কখনো অবশ্য দেখা যায় আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকেই জামাত শিবির বলে চিৎকার করছে।
এই ট্যাগ পাওয়া জামাত শিবিরের তালিকায় আছে দেশের প্রগতিশীল দৃঢ়চিত্তের মানুষেরা, আছে দেশ থেকে বিতাড়িত দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র, আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নাস্তিক- মুক্তমনা, বাম-লিবারেল লোক সহ প্রায় সবাই’ই। যেই ট্যাগের মধ্য দিয়ে ভয়াবহতা হারিয়েছিলো জামাত শিবির নামক আতঙ্ক। পরিস্থিতি শেষে এমন দাঁড়িয়েছে যে- যাকে চিনি, যে পক্ষেই জামাত- শিবির, তাকেও আর ‘তুই রাজাকার’ বলে গালি দেওয়ার ক্ষমতাটা আমাদের কাছে থাকেনি।
যেহেতু ততক্ষণে আওয়ামী ফিল্টারে-
আমরা সবাই রাজাকার
আমাদের এই রাজাকারের রাজত্বে
নইলে মোরা রাজাকারী ট্যাগ পাবো কি সত্ত্বে?
তো প্রথমে উগ্র এবং বিভ্রান্ত জাতীয়তাবাদ চর্চার মধ্য দিয়ে গণহারে আমাদের সবাইকে শিবির ট্যাগ দিয়ে সমকালে হাস্যকররকম সস্তা করে ফেললো আওয়ামিলীগ ‘জামাত-শিবির’ ট্যাগ’কে। সমকালে এটা কত যে বড় একটা ক্ষতি তা আর আলাদা ভাবে বলার প্রয়োজন বোধহয় না আছে।
কিন্তু কাল আওয়ামিলীগ সরকার করে ফেলছে একটা ঐতিহাসিক ক্ষতি।
অদ্ভুত বিভ্রান্তিকর এক রাজাকারের তালিকা তৈরি করে।
যেই তালিকায় অনেক শহীদ- মুক্তিযোদ্ধা সহ আছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম কৌঁসুলিও। ব্যাপারটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য যেমন অবমাননাকর, ঠিক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির জন্য একটা সুযোগ’ও। যেহেতু এই বিতর্কিত তালিকা মাধ্যমে তালিকার ভেতর চিহ্নিত রাজাকারের নামটাও আর বিতর্কের উর্ধ্বে থাকলো না। রাজাকার শব্দটাই করে ফেলা হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে বিতর্কিত, যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের ফারাক সেখানে দৃশ্যমান কিছু থাকেনি আর।
এই ক্ষতির জন্য মুক্তিযুদ্ধো বিষয়ক মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন, ক্ষমাও চেয়েছেন হয়তো। কিন্তু যা করার তা তো করেই ফেলছেন। আমাদের কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছেন বিতর্কাতীত ভাবে রাজাকার’কে ‘তুই রাজাকার’ বলার ক্ষমতা।
একদিকে মুক্তিযুদ্ধের নাম বিক্রি করে দেশ জুড়ে চালানো হয় অদ্ভুত অরাজকতা। সম্মান ধূলায় মিশানো হয় মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বের। সেটা যেমন বড় ক্ষতি। অন্যদিকে রাজাকারের ট্যাগ যারে তারে দিয়ে হাস্যকর করা হয় রাজাকার শব্দের ভয়াবহতাকে। সেটাও একই রকম বড় ক্ষতি। যেই ক্ষতি এই দেশে বিএনপি-জামাত সরকার ও করতে পারে নাই, সেই ক্ষতি এই দেশে করলো কথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি মহান ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকার।
একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও রণাঙ্গনের একজন বীর শহীদের নাতি হিসেবে ব্যাপারগুলো’কে কতটা অসহায়ত্ব আর অপমানের মধ্য দিয়ে যে দেখা লাগে তা এই লেখায় আর বোঝানো সম্ভব নয়।
সম্ভব শুধু ক্ষতিগ্রস্ত চেতনা নিয়ে হা করে কাণ্ডকারখানা গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা। শুধুই কি তাকিয়ে থাকা?
সৈকত আমিন একজন কবি ও লেখক
1 Comment
অসাধারণ! তবে কিছু শব্দের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতনতা দেখাতে পারতেন। আর আপনারা সরাসরি কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে পাঠককে সত্য নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবেন, এটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।
ধন্যবাদ।