আমার বাড়ির পাশেই বাজার।
বাজারের পাশেই গ্রামের খেলার মাঠ।
বিকেলে মাঠের দিকে গিয়ে দেখলাম, মাঠের পাশে বাজারের বড় প্রাচীর সংলগ্ন একটা ছোট ট্রাক ভর্তি চালের বস্তা। দূর থেকেই ট্রাকের মধ্যে মুখ বেধে রাখা ছোট ছোট বস্তা দেখতে পেলাম। ট্রাকের চারপাশে অনেক লোকের ভিড়। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে এখানে সরকারি অনুদান গরীব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তবে এরই মধ্যে অনুমান করলাম চালের বস্তা যে পরিমানের আছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিল।
আগ্রহ নিয়ে আরো কাছাকাছি গেলাম।
সরকারি সাহায্য নেয়া লোকের পাশাপাশি উৎসুক জনতাও কম নয়। নারী-পুরুষ, শিশুরাও অধীর আগ্রহে এই রোদের মধ্যে বসে আছে। দেখলাম, মুখ ভার করে অতি আগ্রহ ভরা চোখের চাহনি নিয়ে এক মহিলা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মনে হলো কিছু খুঁজছে এই চৈত্রের রোদে! পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম যে চাল বিতরণ করা কর্তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে।
কবে কর্তারা আসবে? কবেই বা চাল দিবে তারপর বাড়িতে যাবে।
মহিলাটার কোলে একটা শিশু, আরেকটা ছোট মেয়ে পাশেই দাড়ানো। দুইটা বাচ্চা নিয়ে এই রোদ্দুর পেরিয়ে আসা সহজ নয়। মহিলাকে দেখে মনে হলো সে খুবই ক্লান্ত। চৈত্র মাসের কাঠ ফাটা রোদের শেষ বিকেলের সময়ে আগুন ধরিয়ে দেয় জমিনের বুকে। এই অসহ্য গরমের মধ্যে দুইটা শিশুকে নিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে কিছু চাল আর ডালের আশায়। সহজেই বুঝাতে পারলাম যে এই অসহায় মহিলাটি পাশের কোন গ্রাম থেকে দুইটা শিশু নিয়ে এসেছে। হয়তো তারা গত দুবেলা কিছুই খায়নি, এই চাল ডালের পাওয়ার আশাতেই হয়তো পৃথিবীর সব আশা নিয়েই বসে আছে দু সন্তানের এই জননী।
শুধু এই মহিলা নয় এখানে এমন অনেক লোকই বসে আছে প্রবল আগ্রহ নিয়ে কিছু খাদ্য সামগ্রী পাওয়ার জন্যে। এই চৈত্রের রোদে কিছু চাল-ডাল পাওয়ার আশাতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বসে থাকা এই লোকগুলোর দিকে তাকালে সত্যিই কষ্ট হয়। এই নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোই তাদের ভোট দিয়ে দেশের নীতি নির্ধারকগুলোকে নির্বাচিত করছে, আজ তারা তাদেরকে একটু সাহায্য করতে বাড়ি- বাড়ি না গিয়ে এই রোদে বসিয়ে রেখেছে! ভোটের সময় এই নেতারা ঘরে- ঘরে সুমিষ্ট বুলি আওড়িয়ে ঠিকই ভোট ভিক্ষা চেয়েছিল এই অসহায় মানুষগুলোর কাছে। আজ এই মানুষগুলো নেতাদের কাছে কিছু চাল ডাল পাওয়ার আশায় ধর্না দিচ্ছে, সারাদিন রোদে বসে আছে কিছু পাওয়ার আশায়।
অথচ চাইলেই এসব চাল- ডাল মানুষের ঘরে পৌছে দেয়া যায়। ভোটের জন্য যদি এলাকার প্রতিনিধিরা মানুষের দ্বারে-দ্বারে যেতে পারে তাহলে আজ এই ভয়াবহ মহামারিতে সামান্য চাল- ডাল মানুষের ঘরে পৌছে দেয়া যাবে না কেন?
ঘরে পৌছে দিলে তো আর দল বেঁধে ফটোসেশান করা যায় না! ফটোসেশান করার জন্য হলেও সবাইকে একত্র করে রোদে পুড়িয়ে সরকারে আদেশ অমান্য করে গাদাগাদি ভাবে অনুদান দেয়া লাগবে! এই হলো আমাদের জনপ্রতিনিধিদের অবস্থা। আচ্ছা কেউ কি বলতে পারেন উপজেলা বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাজটা কি? তাদের কি জনগনের শাসক হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল নাকি সেবক হিসাবে? ভোটের সময় ভোট পাওয়ার ধান্দায় এরা সেবক হিসাবে চাপাবাজী করলেও পরে কিন্তুু রক্তচোষা শোষকেই পরিণত হয়।
আর এই রক্তচোষাগুলো রক্ত চুষে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দেয়, এর খবর রাখেই বা কে। মানবিক কারণে হলেও এই বিপর্যয়ের সময়ে বাড়ি-বাড়ি খাদ্য সামগ্রী পৌছে দেয়া কি উচিত ছিল না? ফেসবুকে দেখলাম প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের একজন নেতা ঘরে- ঘরে গিয়ে খাদ্য সামগ্রী দান করছেন। প্রতিটি লোকের দরজায় গিয়ে খাবারের পুটলা দিচ্ছেন আর ফটোসেশান করছেন। ছবিতে দেখলাম একটা মেয়ে খাবারের পুটলি নেয়ার সময় লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তুু ঐ নেতার মুখে দেখলাম দাঁত খেলিয়ে হাসির বাহার!
কেন রে ভাই এতো দরজায় গিয়ে দাঁত খেলিয়ে ফটোসেশন না করলে বুঝি হয় না? ফটোসেশান করার বুঝি আর জায়গা পাওনা? এই মহামারির সময়ে এসব মানুষের দুঃখী মুখগুলোর দিকে তাকালেও তো মুখ দিয়ে হাসি আসার কথা নয়। তাহলে কেন এতো ফটোসেশান করে হাসি? হয়তো তারা এটাই ভাবে যে গরীব লোকদের কোনো লজ্জা নেই! তাদের লজ্জা থাকতে হয় না, এটাই বুঝি এ সমাজের রীতি। তা না হলে বলদের মতো এভাবে দান করতে হবে কেন! অনন্ত একটা দেশের জনপ্রতিনিধিদের এটুকু বাস্তব জ্ঞান থাকা উচিত যে, কোন সময় ফটোসেশান করতে হবে আর কোন সময় নয়।