অনেকেই সরকারের অর্থনৈতিক স্টিমুলাস প্যাকেজের সমালোচনা করে বলেছেন যে সরকার কি নিম্নবিত্তদের কথা ভাবে না? এই প্যাকেজে তাদের জন্য কিছু বরাদ্দ করা হয় নাই কেন? আমার এই প্যাকেজ দেখে এটা মনে হয় নাই যে তারা গরিবদের কথা ভাবে না। আমার মনে হইসে তারা আশা করতেসে এই প্যাকেজ দ্বারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর এতই উন্নতি হবে যে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং এতে করে শেষমেষ সব শ্রেণীর মানুষই লাভবান হবে।
আইডিয়াটা হচ্ছে অনেকটা এরকম যে ব্যবসায়ীরা টাকা সব সময় এমন ভাবে ব্যায় করে যাতে করে অর্থনীতিতে সব চেয়ে বেশি মানুষ সব চেয়ে বেশি লাভবান হয়। মানে, আপনি টাকা দিবেন ব্যবসায়ীদের হাতে, কিন্তু তারা টাকাটা এমন ভাবে ব্যায় করবে যে ঘুরে ফিরে টাকাটা বহুগুনে বেড়ে সকল শ্রেণীর লোকের হাতে পৌঁছে যাবে। অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলা হয় ট্রিকল ডাউন ইকোনমি এবং এই মতাদর্শের রাজনীতিবিদরা এই দর্শনে বিশ্বাসী যে যারা আসলে প্রান্তিক, যারা মজলুম, যারা মিসকিন তারা কেউই পরিস্থিতির শিকার না। তারা গরিব শুধুমাত্র তাদের নিজেদের দোষে। তাদের ভুল মানি ম্যানেজমেন্টের কারনে। তারা কেউ এতিম হিসাবে জন্মায় নাই, তাদের কারো অভিভাবক তাদেরকে ছোট বয়সে পড়াশোনা না করায়ে কোনো এক কারখানায় কাজ করতে পাঠায়ে দেয় নাই। তাদের মধ্যে এমন কোনো মেয়ে নাই যাকে ১০ বছর বয়সে বাল্যবিবাহ দেওয়া হইসে। তার কোনো ছোট বোনকে পতিতালয়ে পাঠায়ে দেওয়া হয় নাই। তাদের মধ্যে কাউকে অপহরন করে হাত কেটে, চোখ গালায়ে ভিক্ষা করতে বাধ্য করা হয় নাই। সুতরাং এদের হাতে টাকা দেওয়াটা আসলে টাকা জলে ফেলার বরাবর হবে। টাকা দিতে হবে ব্যবসায়ীদের হাতে যার মাধ্যমে সবাই উপকৃত হবে। কেননা এদের বিশ্বাস যে যারা যারা বিত্তবান, তারা আসলে নিজের চেষ্টায় ওই অবস্থানে আসছে। তাদের পরিস্থিতি তাদের জন্য কোনো ভাবেই সহায়ক ছিলো না। এদের মধ্যে কেউই শোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় নাই। কেউই অসাধুভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়ে টাকা কামায় নাই। সুতরাং এদের হাতে টাকা দিলেই ওই ভিক্ষুকের আর ভিক্ষা করা লাগবে না, গার্মেন্টসে তার চাকরি হয়ে যাবে। তার জন্য প্রস্থেটিক হাতের ব্যবস্থাও এই গার্মেন্টসের মালিকই করবে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন কারখানা থেকে বের করে এনে তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করবে। পতিতাদের বের করে আনবে পতিতালয় থেকে।
আমার কথা শুনে বুঝতেই পারছেন যে আমি এই ট্রিকল ডাউন ইকোনমিক ননসেন্সের ঘোড় বিরোধী। এইরকম অর্থনৈতিক মতাদর্শ যে সম্পূর্ণ ভুয়া এর অনেক নজির আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি এই মতাদর্শে বিশ্বাসী। তারা মনে করে যে আয়করের হার কমালে সরকারের আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, তা ছাড়া ব্যবসায়ীরা এই বাড়তি টাকা দিয়ে এমন ব্যবসা করবে আর এতই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে, যে সাধারন জনগণ এতে করে ব্যাপক পরিমানে লাভবান হবে আর সেই লাভের কারনে করের হার কম হলেও সরকারের মোট রাজস্ব আয় বেশি হবে। এই আশায় প্রতিবার ক্ষমতায় এসেই রিপাবলিকানরা ব্যবসা ক্ষাতে করের হার কমিয়ে দেয়। কিন্তু দেখা যায় ঘোড়ার ডিম কিছুই হয় না। সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায় আর প্রান্তিক মানুষেরও কোনোই উপকার হয় না। করের টাকা কম দেওয়ার কারনে যেই বাড়তি টাকা ব্যবসায়ীদের হাতে থাকে, প্রতিবারই দেখা যায় যে তারা এই টাকা দিয়ে ব্যবসা না করে তাদের কোম্পানির শেয়ার তারা পাবলিকের কাছ থেকে কিনে ফেলা শুরু করে। ইংরেজিতে এটাকে বলে শেয়ার বাইব্যাক।
তাহলে কোন অর্থনৈতিক পলিসি দ্বারা শ্রমজীবী মানুষেরা সব চেয়ে বেশি লাভবান হবে। আসলে এ বিষয়ে আমার কোনো মতামত দেওয়ারই দরকার নেই। এর উত্তর ইতিমধ্যেই নোবেল বিজয়ী অর্থনতিবিদ দাম্পতি স্বামী-স্ত্রী এসতার দুফলো ও অভিজিৎ ব্যানার্জি বের করে ফেলেছে। তাদের দীর্ঘ তিন যুগ ব্যাপি এই বিষয়ে ক্রান্তিকারী অর্থনৈতিক গবেষনার কারনে তারা ২০১৯ সালে নোবেল পুরুষ্কারও পেয়েছে। নোবেল পেয়েই অভিজিৎ ব্যানার্জি প্রথমেই এই ধরনের কথাই বলেন যে গরিবদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে অর্থনৈতিক সহায়তাটুকুও সরাসরি গরিবদের হাতেই দিতে হবে। প্রথমে টাকা ব্যবসায়ীদের হাতে দিবো এবং ওই টাকা হাত বদল হয়ে গরিবদের হাতেই যাবে এই ধারনাটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটা ধারনা। এইটা তারা গবেষনার মাধ্যমে প্রমান করে ছাড়সে। এই বিষয়ে কেউ আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে এই দম্পত্তির লেখা পুওর ইকোনোমিক্স বইটা পরে দেখতে পারেন। অসাধারন একটা বই।
লেখাটা শেষ করার আগে সরকারকে একটা প্রশ্ন করে যেতে চাই: আপনারা যখন দেখলেন যে এই পরিস্থিতিতে ২ শতাংশ সুদের হারে ৫,০০০ কোটি টাকার প্যাকেজই কোনো কাজে আসছে না, আপনারা কি ভাবে ভেবে নিলেন যে এর চেয়ে দিগুন হারের প্যাকেজের ৫০,০০০ কোটি টাকার স্টিমুলাস কোনো কাজে দিবে?