বাংলাদেশে সরকারি ত্রাণ সরবরাহে দুর্নীতি বা অসামঞ্জস্যতার দুর্নাম বহুকাল ধরে বিদ্যমান। অন্যান্য সকল সেক্টরেই আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ওই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ কম বেশি লক্ষনিয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়টি হোল, বাংলাদেশের ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা রয়ে গেছে মধ্যযুগীয় কায়দায় যা আজকের সমাজে অত্যন্ত অসময়োপযোগী। সম্পূর্নভাবে ম্যানুয়াল (Manual) বা ব্যাক্তি থেকে ব্যাক্তি নির্ভর ত্রাণ ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান রয়েছে যেখানে মন্ত্রণালয় থেকে ধীরে ধীরে বা ধাপে ধাপে স্থানীয় জনতা পর্যন্ত পৌঁছে যাবার কথা। এই পদ্ধতিতে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিবর্গ তৃণমূল পর্যায়ের খবর নিতে প্রায়শই বার্থ হয়। যার কারণে, ত্রাণ বিতরণে নানা রকমের অনিয়মের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। যেমন ধরুন প্রকৃত ব্যক্তিদের ত্রাণ না দিয়ে স্থানীয় মেম্বার বা চেয়ারম্যানদের চেতনা-জানা মানুষদের ত্রাণ সামগ্রী বন্টন করা, বিভিন্ন ধরনের কার্ড জ্বালিয়াতীকরণ, এমনি ত্রাণ সামগ্রী পুরোপুরিই লোপাট করে দেওয়া সহ নানা রকম অনিয়ম।
এই খাতটি সম্পূর্নভাবে জনগণের কল্যাণ পরিপন্থী হয়ে পড়েছে যা মন্ত্রণালয়টির উদ্দেশ্য পরিপন্থীও বটে। এ যুগের তথ্য ও প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে নানা সেক্টরে দুর্নীতি হ্রাসের চেষ্টা বিদ্যমান সারা পৃথিবীতেই। বাংলাদেশেও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নানা ধরণের সরকারি সেবা সহজীকরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনাপূর্বক সারা দেশব্যাপী ত্রাণ সরবরাহের উপযুক্ত করে সেবাটি ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এতে করে যেমন একদিকে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার কাজটি সহজ হয়ে আসবে ঠিক তেমনি স্বচ্ছতার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা ধরি যে প্রস্তাবিত আধুনিকায়নের কাজটি করা যেতে পারে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। এবং ওই অ্যাপটি হবে সকল ফিচার সম্বলিত যেখানে প্রত্যেকটি ত্রাণ গৃহীতা তাঁর নির্দিষ্ট এক ধরণের গ্রহীতা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাগজপত্র দিয়ে একটি একাউন্ট খুলতে হবে যা জাতীয় পরিচয়পত্র ও নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে যেকোনো স্থানে এবং যেকোনো ডিভাইসে লগ ইন করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। যাতে করে প্রত্যেকটি সুবিধা গ্রহিতা ত্রাণ পাওয়ার পরে ত্রাণ সামগ্রীর ছবি সহ মন্তব্য যোগ করা সহ নানা সুযোগ সুবিধা সম্বলিত হতে পারে ওই অ্যাপটি।
এই অ্যাপটি শুধু ত্রাণ বিতরণ নয় বরং যেকোন সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদান যেমন বয়স্ক ভাতা প্রদান, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান, দুঃস্থ ভাতা প্রদান এবং জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সময়েও এই অ্যাপটি হয়ে উঠতে পারে একটি নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম। এ রকমের একটি পদ্ধতি ব্যবহারে মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের এমনকি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত থাকবে সার্বক্ষণিক তদারকির সুযোগ যার ফলে তথ্যগত ছল-চাতুরীর ঘটনা গ্রাস পাবে।
পদ্ধতিগত পরিবর্তন না করে শুধু আকাশে বাতাসে বাণী উড়ালে সেটা বৃথাই যাবে। প্রত্যেকটি সরকারকে বিশেষ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সরকারগূলোকে দেখা যায় তাঁরা টেকসই উন্নয়নের কথার ঝুঁরি উড়াতে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষের মৌলিক অধিকারই যেখানে অনিশ্চিত সেখানে ওই সমস্ত সরকার টেকসই (Sustainable) উন্নয়ন বলতে কি বোঝাতে চায় তা অত্যন্ত ধোঁয়াশে এবং প্রতারণার শামিল। আজ করোনা ভাইরাস যেখানে সারা পৃথিবীব্যাপী মহামারীতে (pandemic) রূপ নিয়েছে, ঠিক ওই সময়েই বাংলাদেশে ঘটছে ত্রাণ সামগ্রী চুরির, ডাকাতি বা রাহাজানির মত পাশবিক ঘটনা। কারণ, এখানে আছে পদ্ধতিগত সমস্যা। এই সমস্যাটি ঠিক কুয়ার মধ্যে বিড়াল পরে থাকার মত। এটা যতদিন পরে থাকবে ততদিন এই দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে না।
সরিফ মোল্লা(হ), পিএইচডি গবেষক (এডুকেশনাল টেকনোলজি),বেইজিং নর্মাল ইউনিভার্সিটি, বেইজিং।