টিএসসির  মোড়ে বসে আছে আবু বকর, বিশ্বজিৎ আর ত্বকী। ওদের গলায় তারিখ দিয়ে একটা করে  ট্যাগ ঝুলানো। আবু বকরের ট্যাগে লিখা ১ই ফেব্রুয়ারি ২০১০, বিশ্বজিতের ট্যাগে  লিখা ৯ই ডিসেম্বর ২০১২, ত্বকীর ট্যাগে লিখা ৬ই মার্চ ২০১৩। ওরা ওইখানে বসে  আড্ডা দিচ্ছে। দেউলিয়ার মতো এদিক ওদিক ছুটছে ফাহাদ। বিষয়টা লক্ষ করে বিশ্বজিৎ  গলা উঁচিয়ে ডাক দিলো,
 ‘এই ছেলে এদিকে আসো।’
 শার্ট পরা ফাহাদ ওদের কাছে আসতেই আবু বকর জিজ্ঞাস করলো,
 ‘কী ব্যাপার এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছো ক্যানো?’
 দরদ ভরা কণ্ঠে ফাহাদ জবাব দিলো,
 ‘ভাই ওরা আমাকে হত্যা করেছে। আমি বিচার চাই, ন্যায্য বিচার। হাইকোর্ট যাচ্ছি, জর্জকোর্ট যাচ্ছি কেউই তো আমার কথা শুনছে না।’
 ফাহাদের কথা শুনে ত্বকী, বিশ্বজিৎ আর আবু বকর উচ্চস্বরে হাসলো। ফাহাদ মন খারাপ করে জিজ্ঞাস করলো,
 ‘হাসছেন ক্যানো? আমি তো কোনো মন্দ কথা বলিনি। আমি আমার হত্যার বিচার চাইছি শুধু।’
 আবু বকর নিজের ট্যাগ দেখিয়ে বললো,
 ‘এটা কি জানো?’
 ‘না।’
  ‘এটা আমার মৃত্যুর তারিখ। সরকারের পাণ্ডারা আমাকে বেধরক পিটিয়ে  মেরেছে। সেদিন থেকেই ন্যায়বিচারের জন্য বসে আছি। ৯ বছর হয়ে গেছে, আজ সবাই  আমাকে ভুলার পথে। তুমি তো আজকে মরলে, আজকেই বিচার চেয়ে বসেছো?’
 আবু  বকরের কথা শুনে ফাহাদ তিনজনের গলার ট্যাগের দিকে চাইলো। বুঝতে চেষ্টা করলো  ঠিক কতদিন যাবৎ তারা এখানে। ফাহাদ মনঃক্ষুণ্ণ করে কাঁদো কণ্ঠে বললো,
 ‘তাহলে কি আমরা কখনোই ন্যায় বিচার পাবো না?’
 বিশ্বজিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
 ‘জীবিতরা আমাদের জন্য লড়ে না ন্যায় বিচার চায় কিন্তু কীভাবে আদায় করতে হয় জানেনা। রাজপথে লড়তে হবে আমাদেরই, আন্দোলন করতে হবে।’
 ফাহাদ চমকে গিয়ে বললো,
 ‘আমরা? আমরা তো মৃত। আমাদের আন্দোলনে কী আর হবে?’
 আবু বকর মুচকি হেসে বললো,
 ‘মৃত তাই আমাদের মরার আর ভয় নেই। জীবিতদের মরার ভয় আছে তাই লড়ে না। আমরা লড়বো, ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনবো।’
 ‘কিন্তু কবে?’
 তিনজনই উঠে দাঁড়ালো। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,
 ‘আমাদের আরো লাশের অপেক্ষা করতে হবে। যারা ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের পাশে আসবে। আমরা একদিন বিপ্লব ঘটাবো।’
 দূর দিয়ে রুদ্র মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ কুঁজো হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আবু বকর ফাহাদের হাত ধরে তারা কাছে গিয়ে বললো,
 ‘ভাই, এই ছেলেটা নতুন এসেছে। একটু সাহস দরকার, একটু কিছু বলবেন কি?’
 রুদ্র বুকে একটা বই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
 আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
 আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
 ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
 এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
 বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
 মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
 এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
 জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
 আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
 এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
 স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
 একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?
 জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
 বাতাশে লাশের গন্ধ
 নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান..
লেখাঃ মুহাম্মাদ আরজু
 
									 
					 
