দশ বছর আগের সার্ভে মোতাবেক ফেনী নদীর শীতকালীন জলপ্রবাহ বা শীতকালে তলানী প্রবাহ বা Base Flow ১২০ কিউসেক ছিল। কিন্তু ৮০ কিলোমিটার সীমান্ত পথে ৩৬ টি বা তার অধিক স্থানে ২ কিউসেক এর বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসিয়ে ভারত অবৈধভাবে পানি তুলে নেয়ায় এর শীতকালীন তলানী প্রবাহ ৫০ কিউসেকে এসে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি বিষেজ্ঞরা (সুত্র- প্রকৌশলী ম ইনামুল হক,চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইন্সটিটিউট)। অর্থাৎ চুক্তির আগেই নদীর জল প্রবাহ অর্ধেক করে ফেলেছে ভারত। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বনায়ন কমার কারণে শুষ্ক ও সেচকালীন মৌসুমে নদীর পানি কমে যাচ্ছে প্রতি বছর। শুষ্ক মৌসুমে ফেনী একটি বিপন্ন নদী।
এমতাবস্থায় বর্তমানের অবৈধ পানি সরানোর পথ বন্ধ না করে ভারত সাব্রুম শহরে জল সরবরাহের লক্ষ্যে ১.৮২ কিউসেক জল তোলার গোলামী চুক্তি করেছে সরকার। আমাদের উচিত সমস্ত অবৈধ পাম্প বন্ধ করে দিয়ে ফেনী নদীকে তাঁর পূর্বের প্রবাহে ফিরিয়ে পরেই নতুন কোন পানি চুক্তির আলোচনায় যাওয়া।
১। ১১ বছর ধরে চলা তিস্তা চুক্তির টালবাহান ও প্রতারণা বন্ধ করে শুস্ক মৌসুমে তিস্তায় জলপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে ভারতকে। এর আগে নতুন কোন পানি প্রদান চুক্তিকে আমরা দ্বিপাক্ষিক নেগোসিয়েশনের কৌশলগত কারণে সমর্থন করি না।
২। বর্তমানে অন্তত ৩৬ টি অবৈধ পাম্প স্টেশন চলছে ফেনীতে। যে কোন চুক্তির আগে সেগুলো সরাতে হবে। সমস্ত অবৈধ পাম্প বন্ধ করে দিয়ে ফেনী নদীকে তাঁর পূর্বের প্রবাহে ফিরিয়ে আনতে হবে। চুক্তির পুর্বেই অর্ধেক পানি হাইজ্যাক করার দুর্বিত্তপণা থামাতে হবে।
৩। নতুন চুক্তিতে শুধু পানীয় জলের কথা বলা হয়েছে, বিদ্যমান অবৈধ সেচ পাম্প গুলোর উল্লেখ নেই, ফলে এই চুক্তি মিথ্যায় ভরা। ভারত নতুন করে ১.৮২ কিউসেকের বেশি পানি নিবে না তার কোন গ্যারান্টি ক্লজ নাই। উল্লেখ্য, গঙ্গায় আনুমানিক ৩১ হাজার কিউসেকের কথা বলে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ হাজার কিউসেক পানি দিচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে, প্রায় ৬০ ভাগের এক ভাগ। এক্ষেত্রে বর্তমানের অবৈধ পানি পাম্পের বাইরেও যে নতুন চুক্তি তারা ভায়োলেইট করবে না তার কোন sগ্যারান্টি ক্লজ আছে কি?
৪। ফেনি নদীর পানি সাভ্রামে নিবার এক্সচেঞ্জ হিসবে বাংলদেশ কুশিয়ারা নদীর কিছু পানি চেয়েছিল। ভারত দিতে রাজি হয়নি। পারস্পরিক দেয়া নেয়ার এক্সচেঞ্জ চাড়া যে কোন চুক্তি অসম ও গোলামীর।
৫। ফেনী নদীর জল প্রদান মানবিক দিক থেকে দেখানো হলেও সাভ্রামে দুর্ভিক্ষ হচ্ছে না, সেখানে তীব্র পানি সংকটের বা মানবিক সংকটের কোন তথ্য আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাইনি। দক্ষিণ এশিয়ার বহু শহরে এমনিতেই সাধারণ পানি সংকট আছে, যার অনেক কারণের মধ্যে দুটি হচ্ছে পানি অপচয় এবং অ টেকসই পানি ব্যবহার নীতিমালা।
৬। প্রতি সেকেন্ডে যদি ১.৮২ কিউসেক বা ৫১.৫৩৭ লিটার পানি প্রত্যাহার মানে হল-
১ মিনিটে ৩,০৯২ লিটার
১ ঘন্টায় ১,৮৫,৫৩২ লিটার
১ দিনে ৪৪,৫২,৭৯২ লিটার
১ মাসে ১৩,৩৫,৮৩,৭৪৮ লিটার
১ বছরে ১ ৬০,৩০,০৪,৯৬৬ লিটার (১৬০ কোটি লিটার)
বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর তুলনায় খুব জীর্ণ শীর্ণ ফেনী নদী। শুকনোর সিজনে মুহুরি সেচ প্রকল্পের চাহিদার বাইরে গিয়ে দিনে সাড়ে চুয়াল্লিশ লক্ষ লিটার পানি যাবে ভারতে, একটি শুকনো মাসে ১৩ কোটি পৌনে ৩৬ লক্ষ লিটার, বর্তমানের মাত্র ৫০ কিউসেক পানি থেকে অতিরিক্ত হিসেবে এই পানি চলে গেলে, বাংলাদেশ সেচ চালাবে কি দিয়ে? নদী ও নদী প্রাণ বৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখতে প্রবাহ অব্যহত রাখতে যে পরিমাণ পানি প্রবাহ একটি নদীতে সংরক্ষন করতে হয় তাই বা আসবে কোত্থেকে?
পানি সংকট আমাদের ঢাকা ও চট্রগ্রামেও আছে, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে। ওয়াসা তীব্র পানি সংকটে ভোগে সর্ব ভারতীয় দূষণ বয়ে নিয়ে আসা শোধনের অক্ষম পানির কারণে, পানি স্বল্প। ফলে এই মানবিক দিকের উল্লেখ আসলে গোলামীর শর্ত পূরণের আবিস্কার মাত্র।
বাংলাদেশ সরকারের কাউকে তো তিস্তা আর কুশিয়ারা অববাহিকার মানুষের পানির অধিকার, তাদের পানি কেন্দ্রিক জীবনযাত্রার অধিকার আর তাদের সেচের অধিকারের মানবিক দিকগুলো নিয়ে কথা বলছেন না? এই সরকার কোন দেশের তাবেদারি করে? কিসের বিনিময়ে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ্য, পানি ও পরিবেশগত নিরাপত্তা গুলোকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে?
আমরা মনে করি, ফেনী নদীর পানি প্রদান চুক্তি কৌশলগত ভুল, এর ফলে তিস্তার পানি আদায়ের কাউন্টার নেগোসিয়েশন পাওয়ার কমে গেল। কুশিয়ারার পানি পাবার দরাদরি করার একটি হাতিয়ার হাতছাড়া হয়ে গেল। ফলে চুক্তিটি অসময়ের এবং একই সাথে দেশ বিরোধী।
লেখকঃ ফাইজ তাইয়েব আহমেদ , গবেষক
পড়ুন : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভারতীয় রাডার : নানাবিধ ঝুঁকি