নারী! আমার মা! আমার বোন! আমার স্ত্রী! আমার মেয়ে! সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা, সম্মান যার জন্য সে হলো নারী! আমরা সবসময় চাই যেন আমার পরিবারের নারীরা সম্মান নিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। তাদের নিরাপত্তার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকি। কিন্তু কতটা দিতে পারছি মায়েদের নিরাপত্তা? কতটা স্বাধীনতার সুখ তারা পাচ্ছেন এই দেশে?
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দেশের সার্বিক কাঠামো উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ভেবে আনন্দিত হই। নারীর ক্ষমতায়ণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা ইতিবাচক। কিন্তু এত উন্নয়ন আর নারীর ক্ষমতায়ণের পরেও আমরা নারীর নিরাপত্তা দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। কিন্তু কেন?
নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান দিনদিন খুবই খারাপের দিকে নামছে। ইভটিজিং, ধর্ষণ এমনকি ধর্ষণ করে খুন করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এর কারন হিসেবে দেখা যায়, নৈতিক অবক্ষয়, প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অপব্যাবহার। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে মরে তার স্ত্রী, মেয়ে বাইরে গেলে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে কিনা! দেশে এত বেশি পরিমান নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে যে লিখতে বসে দ্বিধায় পড়ে গেছি নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলবো নাকি নির্যাতন? নারীর ক্ষমতায়ণের বুলি আওড়ে আমরা যতই জাবর কাটি না কেন দেশে নারীর ক্ষমতায়ণের চেয়ে নির্যাতন টাই বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ যেন ধর্ষণের রাজ্যে পরিনত হয়েছে। ঘরে বাইরে সবখানে নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, নারী লাঞ্চনার শিকার হয়ে ঘটছে অনাকাঙ্খিত অনেক দুর্ঘটনা। আমরা নারীদের সম্মান দিয়ে আগলে রাখার বদলে তাদের উপর চালাচ্ছি দানবীয় কালোহাত। নিরাপত্তা দিতে এতটাই ব্যর্থ হচ্ছি, যার ফলে ধর্ষণ খুন হচ্ছে অনায়াসে। এই ঘটনাগুলোর হচ্ছেনা সঠিক বিচার। অপরাধিও পরবর্তী অপরাধ করতে দ্বিধা করেনা। লাঞ্চনা সইতে না পেরে নারী করছে আত্মহত্যা। এই মৃত্যুর দায় নিবে কে?
আমরা কতিপয় যখন নারীকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা ভাবছি, তখন একটা মানুষরূপি জানোয়ার শ্রেণীর মাথায় ঘুরছে ঠিক উল্টোটা। তারা পথে ঘাটে, যানবাহনে, কর্মস্থলে এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্টানে নারীদের উপর হয়রানিমূলক কর্মকান্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে। যার বেশিরভাগ ঘটনা চাপা পড়ে যায় আত্মসম্মানের ভয়ে কিংবা সামাজিক দুর্বল অবস্থান ইত্যাদি কথা ভেবে। আর যাও কয়টা ঘটনা সামনে আসে, প্রশাসনের আওতায় যায় তার হয়না কোনো সঠিক বিচার সুরাহা! ফল লাঞ্চিতা নিরবে কাঁদে কিংবা আত্মহত্যা! ইদানিংকালে দেশে বেশ কিছু নারী নির্যাতন ও ধর্ষনের ঘটনায় সারা দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও হৈচৈ তৈরী হয়। অথচ দেশের নারীবাদী খ্যাত কতিপয় সুশীল সদস্যরা ব্যাঙের মতো খাটের তলায় লুকিয়ে যায় অপরাধির দম্ভ আর ক্ষমতার চাপে। দেশের জনগনও হুজুগেপনা দেখানো শেষ হয়ে গেলে আর কোনো খবর নাই। আমরাও ফেসবুক, টুইটারে দায়সারা, লোক দেখানো পোস্ট করে মুক্ত হয়ে শান্তির ঘুমে মগ্ন হই। কিন্তু যখনই তা আমাদের দিকে এগিয়ে আসে শুরু করি কাঁন্নাকাটি। সুশীল সাজা নারীবাদীদের কথা তো বলবোই না! কেননা, ওরা নারীবাদী হতেই পারেনা। ধর্ষনের রাজ্যে সবকটা নারীভোগী সুবিধাবাদী! যার প্রমান আমরা দেখতে পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি।
নোয়াখালির সূবর্ণচর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যতগুলো ধর্ষনের ঘটনা ঘটছে একটাতেও আমরা কোনো নারীবাদীর মুখে রা শুনিনি। সূবর্ণচরে নৌকায় ভোট না দেয়ায় বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে চার সন্তানের জননী গৃহবধুকে গনধর্ষণ করে আওয়ামী ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীগোষ্টি। দেশে প্রতিদিন কোনো না কোনো নারী লাঞ্চনা ও ধর্ষনের ঘটনা ঘটছে। অথচ আমাদের নারীবাদীরা চুপ থেকে কি প্রমান করে? কিন্তু কোনো প্রভাবশালী ছায়ায় চলা কারো দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেই তারা কোথা থেকে যেন রাজপথে এসে চিল্লানো শুরু করে। যা তাদের ভাড়ায় খাঁটা পেশাদারিত্বের প্রমান দেয়।
ফেনির সোনাগাজীতে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম নেক্কারজনক ঘটনা ঘটলো। মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ধর্ষন করা হয়, তার প্রতিবাদ করায় আগুনে পুড়িয়ে খুন করে তারই শিক্ষক ও সহপাঠি। যার প্রতিবাদে সরব ছিল জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোও। অথচ আমাদের নারীবাদীদের তখন খুঁজে পাওয়া যায়না। কোথায় যেন গরম বিছানায় গভীর ঘুমে মগ্ন তারা। একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হলো কিন্তু এখনো কোনো বিচার নাই!
ঘটনার স্বীকারোক্তিমূলক প্রমান হওয়ার পরেও কোনো শান্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া প্রমান করে নারীর নিরাপত্তা দিতে আমাদের বিচার বিভাগও কতটা অসহায়। ক্ষমতার কাছে বন্দী হয়ে গেছে গোটা রাষ্ট্র। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হয়ে গেছে একটা নির্দিষ্ট গোষ্টির ব্যক্তিগত সম্পদ। হবেনা ই বা কেন? পুলিশ তো নিজেই ধর্ষণ করে। খুন, গুম এবং ধর্ষণের সাথে তো পুলিশের সরাসরি সম্পর্ক। যা দেখা যায় যাত্রাবাড়ি থানার এসআই সহ আরো দুজনকে ধর্ষণের অপরাধে বরখাস্ত করা হয়। এমনকি সারাদেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে নারী লাঞ্চনা ও ধর্ষণের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়। খুব ভাবার বিষয় নির্যাতিতা নারী অভিযোগ নিয়ে যাবে কার কাছে? আরেক নির্যাতনকারীর কাছে?
ধর্ষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে কে কাকে কখন কোথায় ধর্ষণ করছে তার কোনো হিসেব নাই। কে ধর্ষিতা হচ্ছেনা আজকের বাংলাদেশে?
কোটিপতির কন্যা থেকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কন্যা, ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্টি ও সংখ্যালঘু নারী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী সংখাগরিষ্ট নারী, ছিন্নমূল পথবাসী থেকে সম্ভ্রান্ত বিলাসবহুল গৃহবাসী নারী, অল্পবসনের আধুনিকা নারী থেকে হিজাব পরিহিতা সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারী, পাঁচ বছরের শিশু থেকে পাঁচ সন্তানের জননী, কেউই নিরাপদ নয় আজকের স্বাধীন দেশে! নৈতিকতার এতটাই অধঃপতন হয়েছে কে কাকে ধর্ষণ করছে তার কোনো ঠিকটিকানা নাই। চলন্ত বাসে যাত্রীকে, রাস্তায় চলা পথচারিকে, ডাক্তার রুগীকে, অফিসে বস অধীনস্তকে, মানুষ গড়ার কারিগর খ্যাত শিক্ষক ছাত্রীকে, গৃহকর্তা কাজের বুয়াকে, এমনকি যেখানে নারী সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে সেই ঘরের মানুষ কোনো আত্মীয়! একটা সমাজ ও তার বাসিন্দাদের মানসিকতা কতটা পঁচে গেলে এমন অবস্থা হয় তা কল্পনা করতেই গা গুলিয়ে আসে। কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। কর্মস্থল কিংবা ঘরে, গ্রাম কিংবা শহরে, পাবলিক প্লেস কিংবা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টিত সেনানিবাস এলাকায়, নির্জন এলাকা কিংবা গণজমায়েতে, শিক্ষাপ্রতিষ্টান কিংবা সংস্কৃতি কেন্দ্রে কোথাও না। অথচ আমরা নারীর ক্ষমতায়ণের বুলি আওড়ে সবকিছু এড়িয়ে যেতে চাই।
আন্তর্জাতিক মহলে তৈরী হচ্ছে বিরুপ প্রভাব। নারীর ক্ষমতায়ণের দেশে এত এত নারী নির্যাতন আর ধর্ষণ। কিন্তু কেন? এর সঠিক বিচার হয়না কেন? এই বছরের শুরুর দিন থেকে নিয়ে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ধর্ষণের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছেই। এক শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমগুলোও যেন কোনো এক গোপন ইশারায় এগুলো এড়িয়ে যেতে চায়। তবুও যারা তা তুলে ধরেন সেই হিসাব অনুযায়ী বছরের প্রথম একশো দিনে প্রায় চারশো ধর্ষণের মামলা! কদিন আগের মানবজমিন পত্রিকায় দেখলাম একদিনেই ষোলটি ধর্ষণের খবর এসেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে সামনে না আসা চোখের আড়ালে আত্মসম্মান আর সামাজিক দুর্বল অবস্থানের ভয় চাপা পড়ে যায় কতশত ঘটনা তা ভাবার বিষয়! এমনকি বিদেশী পর্যটকরাও এর থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। মায়ের সাথে বেড়াতে আসা পাকিস্তানি তরুণী, কক্সবাজারে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক সহ আরো বিদেশী ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার না পেয়ে ফিরছে। এতে কি বিদেশে আমাদের মান সম্মান খুব বেড়ে যায় ভেবে পাইনা? পাকিস্তানি তরুণীকে ধর্ষণ করে নাহয় আমরা একাত্তরের শোধ নিয়ে চেতনা প্রদর্শন করলাম! কিন্তু অন্যান্যদের? কি জবাব আছে আমাদের?
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? কোনো কার্যকরী চেষ্টা কি আমরা আদৌ করছি? নাকি স্লোগান, মিটিং করেই কান্ত দিচ্ছি। আমাদের নারীবাদীদের কেন কোনো খবর নাই। তারা কেন কুয়োর ব্যাঙ হয়ে বিছানা গরম করতে ব্যস্ত? কেন তারা শুধুমাত্র একটা অংশের জন্য রাজপথে, সংবাদ সম্মেলনে ভাড়ায় খাঁটবে? সমাজের সকল শ্রেনীপেশার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করতে কেন তাদের বাধে? নারীবাদীরা কেন সুবিধাভোগি আর সুবিধাবাদী হয়ে সমাজের সাথে প্রতারণা করে? এর কি কোনো জবাব নাই? বদলাতে হবে! আমাকে, আপনাকে সবাইকে বদলাতে হবে! বদলে যাও, বদলে দাও স্লোগান শুধু মুখে না রেখে পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে তা বাস্তব প্রমান করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধমুক্ত থাকবে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা সময়ের দাবি। সূবর্ণচর থেকে সোনাগাজী যত অপরাধ প্রমানিত হয়েছে তার শাস্তি প্রদান করতে হবে। ক্ষমতার অপব্যাবহার করে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করা বন্ধ করে সঠিক বিচার করতে হবে। আমরা চাইনা আর কোনো নারী নির্যাতন আর ধর্ষণের শিকার হোক। আমাদের মা-বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। স্বাধীন দেশে তারা যেন স্বাধীনতার সুখ পায়, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। এর জন্য সঠিক বিচার করতে হবে।
পাশাপাশি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করবে ধর্মীয় মূল্যবোধ। জীবন যাপনে ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়া। নারীরা নিজেকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে না দিয়ে বরং ধর্মীয় নৈতিকতার ভিতরে থেকে নিজেদের অধিকার আদায় ও দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমাজে ধর্মীয় নৈতিকতার প্রসার ঘটাতে হবে। ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলতে পারলেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব!
লেখকঃ
আবু সাঈদ (খুশি)
কবি ও কলামিস্ট (শিক্ষার্থী- দর্শন বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)