সকালে যার সাথে বসে নাশতা করে এসাইনমেন্টে গেছে ফিরে এসে দেখে সে অফিসে নাই, যার সাথে এক গাড়িতে ইউনিট নিয়ে চাপাচাপি করে কাজ শেষে অফিসে ফিরেছে পরদিন থেকে সে আর অফিসে আসে না। এ নিয়ে কেউ তেমন একটা বিচলিতও নয়। কে জানে পরদিন হয়ত তার জন্যও একই পরিস্থিতি অপেক্ষা করে আছে, এটাই এখানকার কালচার। মুখ খুললেই আপনার চাকরি নাই। বলছিলাম গণমাধ্যমগুলোর কথা।
পৃথিবীর সকল পেশাজীবীদের সংগঠন কর্মীদের অধিকার, সুরক্ষা নিয়ে কথা বলে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠনগুলো পর্যন্ত নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার। ডাক্তাররা তো কর্মবিরতিও পালন করতে পারে। শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের উদাহরণ ভূরি ভূরি। কিন্তু এই খবরগুলোই যারা সংগ্রহ করে, কেটেকুটে পরিবেশনযোগ্য করে, প্রচার কাজে সহায়তা করে হোয়াট এবাউট দেম?
সারা বিশ্ব যখন লকডাউনে তখন এরা হয় অফিসে ছুটছে নাহয় ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। যারা অফিসে যাচ্ছেন- গিয়েই ছুটছেন কবরস্থান, কুয়েত মৈত্রী-কুর্মিটোলা- ঢাকা মেডিকেল বা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দিকে। কেউ কেউ পিপিই পেয়েছে, কেউ হয়ত গ্লাভস-মাস্ক। আর কেউ কিছুই পায়নি। কী পেয়েছে সেটা বড় কথা নয়, বাঁচি-মরি খবর আনতেই হবে এটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এ তো গেল এক ধরণের মিডিয়ার কথা।
আরেক ধরণের মিডিয়া আছে যারা ‘সংবাদ-শ্রমিক’দের ঠিকমতো বেতন-বোনাসই দেয় না, তাদের জন্য এই করোনা আশীর্বাদ। এই সুযোগে কর্মীদের ছাঁটাই করে সংখ্যা কমিয়ে ফেলছে। কে কথা বলবে এসব নিয়ে? মানুষই যখন সকাল-বিকাল টুপটাপ মরে যাচ্ছে, জীবন বাঁচানোই যেখানে প্রধান কনসার্ন তখণ কর্মী ছাঁটাই বা পিপিই বা গ্লাভস-মাস্ক নিয়ে কথা বলা ‘হাস্যকর’ই বটে।
আরো আছে ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার, রাইটার ও কন্ট্রিবিউটর, যারা কনট্রাক্ট বেসড ছবি তোলেন বা পত্রিকায় লেখেন। তাদের তো ইনকামই বন্ধ। বড় বড় এজেন্সিগুলোর প্রজেক্ট বন্ধ। লাইফস্টাইল বা আইটি পাতার কাজ বন্ধ। ফলে তাদের অনেকেই হয়ত না খেয়ে বসে আছে।
উপায়ান্তরহীন এই গণমাধ্যমকর্মীরা এখনো চাইলেই ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না।
নোয়াব, এটকো, এডিটরস গিল্ড, সম্পাদক পরিষদ ও বিজেসির সাথে ৩০ মার্চ ও সর্বশেষ গতকাল ১১ এপ্রিল তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে গণমাধ্যমের সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় তথ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বেতন পরিশোধের জন্য মালিকদের আহ্বান জানান। এছাড়াও ‘যে বিলগুলো আছে, তা যেন সরকার তাড়াতাড়ি ছাড় করতে পারে সে বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে’ বলেও জানান তিনি। কিন্তু সে আলোচনার ফলাফল কী, কবে নাগাদ বিলগুলো গণমাধ্যমের কাছে এসে পৌঁছবে, ফ্রন্টলাইন সাংবাদিকদের জন্য এই মুহূর্তে কী কী দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে কোন সুস্পষ্ট তথ্য নাই। থাকলেও আমার কাছে এসে পৌঁছায়নি।
গণমাধ্যমগুলোর সীমাহীন অপরিণামদর্শীতার ফলে এখন ইনডিপেনডেন্ট, যমুনা, দীপ্ত ও এটিএন নিউজের চার সংবাদকর্মী এখন করোনা আক্রান্ত। তাদের জন্য অফিস কী ধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছে জানি না। শুধু জানি এখনো সাংবাদিকরা ১২/১৫ ঘণ্টা না খেয়ে (যেহেতু সব হোটেল বন্ধ এবং গণমাধ্যমগুলোয় খাওয়ার ব্যবস্থা নাই) টানা কাজ করে যাচ্ছে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং চাকরির নিশ্চয়তা দুই-ই কমিয়ে মানুষের ঘরের টিভি-মোবাইল ফোনের স্ক্রিন পর্যন্ত খবর পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু এই মানুষগুলো আক্রান্ত হলে, গণমাধ্যমে মড়ক লাগলে সারাদেশের কেউই বাঁচবে না। কেউ মরবে খাদ্যহীনতায় আর কেউ তথ্যহীনতায়।
এমতাবস্থায়, অন্যান্য ফ্রন্টলাইন ফাইটারদের মতো সকল মিডিয়াকর্মীদের পিপিই ও সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত, স্বাস্থ্যবীমা প্রদান, বেতন-ভাতা সঠিক সময়ে পরিশোধ ও আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ, তহবিল গঠনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত সাহায্য প্রার্থনা করছি।
বীথি সপ্তর্ষি, গণমাধ্যমকর্মী