করোনার চেয়ে শক্তিশালী আমরা কথায় কথায় উগান্ডা হন্ডুরাস নিয়ে ট্রল করি। এই হন্ডুরাস করোনা টেস্ট করিয়েছে এপর্যন্ত ১৬০০ টি, যেখানে তাদের জনসংখ্যা মাত্র ৯৫ লক্ষ, এককোটিরও কম। অপরদিকে আমাদের ১৭ কোটির বিপরীতে টেস্ট ১৪৮৬৮ টি।
অর্থাৎ প্রতি দশ লক্ষ লোকে হন্ডুরাস টেস্ট করেছে ১৬৮ জনের, যেখানে বাংলাদেশ টেস্ট করেছে ৮৭ জনের। মানে অর্ধেক। এটাও মনে রাখবেন যে তাদের প্রথম কেস ধরা পড়েছে আমাদেরও পর, দশই মার্চ৷ যেখানে আমাদের ধরা পড়েছিলো সাতই মার্চ।
আচ্ছা আফ্রিকার দেশ উগান্ডার কি অবস্থা? যাকে নিয়ে আমরা হরহামেশাই ট্রল করি নিচুসারির দেশ ভেবে?
সেই ৪.২ কোটির দেশ উগান্ডায় টেস্টের পরিমাণ ৬৬৬১, মানে প্রতি দশ লাখে ১৫৮ জন। মানে তারাও বিডিকে ডাবল ব্যবধানে ফেলেছে।
সেই সাথে এটাও বলে রাখি তাদের প্রথম কেস ধরা পড়েছে ২১ মার্চ, আমাদের দুইসপ্তাহ পরে বলতে গেলে টেস্ট শুরু করেছে তারা এবং এই অল্প সময়েই এগিয়ে গেছে অনেকটা।
আচ্ছা এবার আসি আমাদের এশিয়াতেই। ভিয়েতনাম। যাদের জিডিপি পার ক্যাপিটা আমাদের কাছাকাছিই। উন্নয়নশীল দেশ। সুতরাং আমরা তাদের সাথে সমানে টক্কর দিব, এক্সপেক্ট করা যায় কিনা? উহুঁ ভুল ভাবছেন। ওদের প্ল্যানিং আর বিডির প্ল্যানিংয়ে ঈগল বনাম টুনটুনি টাইপ তফাত। ভিয়েতনাম এখন পর্যন্ত টেস্ট করিয়েছে এক লক্ষ বত্রিশ হাজার সাতশো একাত্তরটি। জ্বি ঠিক ধরেছেন। সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার দেশ হলেও তাদের টেস্টের পরিমাণ ১,৩২,৭৭১।
অর্থাৎ প্রতি দশ লাখে প্রায় ১৩৯০ জন। আমাদের ষোলোগুণ। এটা ঈগল বনাম টুনটুনিও না। এটা হলো টেরোড্যাকটিল বনাম হামিংবার্ডের মত অবস্থা! অথচ ভিয়েতনামের চীনের সাথে একাধিক বর্ডার আছে। তেইশে জানুয়ারি প্রথম কেস ধরা পড়ার সাতদিনের মাথায় তারা চীনের সাথে বর্ডার ক্লোজ করে দেয়। এয়ারপোর্টেও নেয়া হয় প্রটেক্টিভ ব্যবস্থা, যেখানে আমরা মনের আনন্দে সিটি নির্বাচন, যাত্রী আনা-নেয়া, ট্যুর চালিয়েছি সেখানে ভিয়েতনামিজরা জানপ্রাণ দিয়ে করোনা ঠেকিয়েছে। যার ফলস্বরূপ এখন ভিয়েতনামে ২৬৭ জন কোভিড পজিটিভ হলেও মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য।
আচ্ছা একটু কাছে আসি। ঘরের পাশেই নেপালের কথা বলি। নেপালের সাইজ আমাদের মত, তবে জনসংখ্যা মাত্র ২.৪ কোটি। আমাদের মত আগাতলা না ভেবে ডজনে ডজনে বাচ্চা পয়দা করতে নেপালি দের আপত্তি। যাই হোক, এই নেপালে কয়জন করোনা পজিটিভ জানেন? মাত্র ষোলোজন। যার মাঝে আবার একজনকে সুস্থ করে ফেলেছে তারা। এর মাঝে দুইজন হলেন আবার বিদেশী। সে হিসেবে দেশী লোক চৌদ্দোজন এসব পড়ে ভাবছেন নেপালে নিশ্চয়ই রিসেন্টলি ঢুকেছে করোনা? উহুঁ, ভুল ভাবছেন। নেপালে প্রথম কেস ধরা পড়ে চব্বিশ জানুয়ারি। মানে প্রায় তিন মাস আগেই৷ সাথে সাথে তারা আইসোলেশন সেন্টারের ব্যবস্থা করে টেকু তে, পিপিই সাপ্লাই দেয় প্রথমে নেপাল পুলিশ, ত্রিভুবন ও পাতান হসপিটাল এবং ধাপেধাপে বাকি হাসপাতালগুলোতেও। এসবই হয় ঐদিন রাতারাতিই। অর্থাৎ আরো আগে থেকে মানে ডিসেম্বর থেকেই তারা পিপিই ও মাস্ক উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো। নেপালে দ্বিতীয় কেস ধরা পড়ে তেইশে মার্চ এবং ঠিক তার পরদিনই সমস্ত দেশ লকডাউনে চলে যায়। নেপালের এই বিদ্যুতের মত করোনাকে ট্যাকল দেয়ার পুরস্কার স্বরূপ এখনো সেদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ তে আটকে আছে। তাছাড়া ত্রাণ ব্যবস্থাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা সমানে, চালচোর নামের শুয়োররূপী মেম্বার চেয়ারম্যান নেপালে নেই।
বাই দা ওয়ে, গোমূত্রখোর, রাস্তায় টয়লেট করা নিয়ে পাশের যে দেশকে ট্রল করেন সেই ভারতের দক্ষিণে কেরালা এখন আক্রান্তের সংখ্যাকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আটকিয়ে, এমনকি সবচে দাঙ্গাবাজ নামে পরিচিত উত্তরপ্রদেশেই করোনা টেস্ট করার জন্য অলরেডি চারটা ল্যাব প্রস্তুত, যেখানে ঢাকা-চিটাগাংয়ের বাইরে আমাদের ল্যাবের ল ও নেই।
শেষ করি যুদ্ধ বিগ্রহে ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া ফিলিস্তিন কে দিয়ে।
আমাদের প্রায় সাথেই, ওয়েস্ট ব্যাংকে প্রথম কোভিড রোগী ধরা পড়ে ফিলিস্তিনে। আমাদের ৭ মার্চ, ওদের ৫ মার্চ। অথচ এ কয়দিনে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশটাতে টেস্টের পরিমাণ ১৭,৩২৯ টি। প্রতি দশ লাখে প্রায় সাড়ে তিন হাজার জন। আমাদের? ৮৭ জন ।
ডাক্তারদের আহাজারি সত্ত্বেও পিপিই সরবরাহ না করা, দফায় দফায় এয়ারপোর্টে আক্রান্ত দেশ থেকে যাত্রী ঢোকানো, তাদের পর্যাপ্ত কোয়ারান্টাইন সুবিধা দিতে না পারা, প্রবাসীদের দেশে এসে গাছাড়া ঘোরা, প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা, ত্রাণের চাল মেরে মাটিতে দাফন করা, করোনার ভয়ে মাবাবাকে ফেলে সন্তানের পালানো, করোনা কিছু করবেনা বলে ওয়াজে গলাবাজি, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের নার্ভাসনেস, মেডিকেলে মেডিকেলে রোগী হয়রানি, করোনার লক্ষণ গোপন রেখে পুরা জেলায় রোগ ছড়িয়ে দেয়া, শ্রমিকদের ডেকে এনে হয়রানি, শিল্পমালিকদের ব্ল্যাকমেইল, লকডাউনেও হু কেয়ারস এটিচিউড নিয়ে সবার ঘোরা, বিবাড়িয়ায় সংঘর্ষের ট্রল এবং অতঃপর সর্বশেষ সংযোজন হলো সময়মত চিকিৎসার অভাব ও অবহেলার কারণে একজন ডাক্তার, একজন যোদ্ধার অসহায় মৃত্যু।
এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম।
একটা অণুজীবের কাছে কেমনে সতেরো কোটি জীব জিম্মি হয়ে পড়ে তা দেখছি। কিভাবে একটা ভাইরাস এদেশের মাথা থেকে লেজ- পুরো প্রশাসনকে পাগলা নাচাচ্ছে সেটাও দেখছি।
তাই অনুরোধ, কেউ পারলে দেশটাকে একটা কাপড় দিয়ে যাইয়েন। কোভিড- ১৯ নামে পয়েন্ট ওয়ান মাইক্রোমিটারের একটা অণুজীব বাংলাদেশের কাপড় নিয়ে পালিয়েছে। তাই দেশটার প্রশাসনিক ব্যবস্থা এখন সবার সামনে উলঙ্গ। করোনার চাইতে শক্তিশালীদের এমন উলঙ্গ থাকা মানায়না।
অর্পিত চৌধুরী