শ্বৈরশ্বাসনের অনেক কঠিন সমর্থকদের মুখেই শোনা যাচ্ছে যে আমরা যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র না হয়ে একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতাম তাহলে ঠিক চীনের মতন খুব সহজেই কোরোনা ভাইরাসের বিস্তারটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম। সমস্যা নাকি গণতন্ত্র। একনায়কতান্ত্রিক দেশ হলেই নাকি জোর করে লোকজনদেরকে ঘরের ভিতরে ঢুকায়ে রাখতে পারতাম এবং সমস্যা এক মাসের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাইতো। এখন চীন তাদের কোরোনার পরিসংখ্যান নিয়ে সত্যি বলছে কিনা এই বিষয়ে যে ব্যাপক সন্দেহের কারন আছে সেই আলোচনায় না গেলাম। আমাদের দেশের আলোচনায় আশি।
প্রথমত, গত ১২ বছর তো আমরা একনায়কতান্ত্রিক দেশই ছিলাম, হঠাৎ করে এই কোরোনার টাইমে গণতান্ত্রিক কেমনে হয়ে গেলাম। শহিদুল আলমকে রাতের অন্ধকারে বাসা থেকে উঠায়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা একনায়কতান্ত্রিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গুম করে দেওয়ার সময় আমরা একনায়কতান্ত্রিক, ভোট কারচুপি করার সময় আমরা একনায়কতান্ত্রিক, সামান্য ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধে দেশের জনগনকে জেলের ভাত খাওয়ানোর সময় আমরা একনায়কতান্ত্রিক, কিন্তু হঠাৎ করে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের সময় যদি বলি যে না বাবা, একটা গণতান্ত্রিক দেশে এই ক্রাইসিস ম্যানেজ করা সম্ভব না, তখন জিনিষটা কি হাস্যকর হয়ে যায় না? দক্ষিন কোরিয়া কি অগণতান্ত্রিক দেশ? তাইওয়ান কি অগণতান্ত্রিক দেশ? তাহলে তারা কেমনে এতো সুন্দর ভাবে এই ক্রাইসিসটা ম্যানেজ করলো?
এই ক্রাইসিসের সময় আমাদের সরকারের যে ব্যর্থতা গুলি সামনে ভেসে আসছে সেই ব্যর্থতার বেশিরভাগই সরাসরি একনায়কতান্ত্রিক শ্বাসনের ফলাফল। আপনার কাছে মনে হতেই পারে যে একটি একনায়কতান্ত্রিক শ্বাসন ব্যবস্থায় খুব সহজেই মানুষকে বাসায় বসে থাকতে বাধ্য করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা মোটেও এরকম না। আমাদের দেশের জনসংখ্যা যদি হতো ৫০০ আর আমাদের দেশের আয়তন যদি হতো শিশুপার্কের সমান তাহলে হয়তো এটাই বাস্তবতা হতো। কিন্তু আপনি যদি ১৬ কোটি মানুষের দেশে, দেড় লক্ষ বর্গকিলোমিটারের দেশে রাজার রাজত্ব কায়েম করতে চান, তাহলে বাস্তবতা কখনোই এরকম হবে না।
এতো বড় দেশে কেউ কখনোই অবৈধভাবে, অগণতান্ত্রিকভাবে, কোনো ধরনের সমর্থন ছাড়াই ক্ষমতা আগলে ধরে রাখতে পারে না। এর জন্য আপনার দরকার প্রশাসনের সমর্থন, মাঠ পরযায়ে কর্মীদের সমর্থন, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেম্বার, ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান এদের সমর্থন। এরাইবা কেনো আপনাকে অবৈধভাবে, অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে দিবে যদি আপনি এদেরকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি করতে না দেন? আপনার একনায়কতান্ত্রিক শ্বাসন যদি তাদের ব্যক্তিস্বার্থেই কাজে না আসে তাহলে তারাই বা কেনো আপনার রাজত্বে খুশি থাকবে। মনে আছেতো ছোটবেলায় শেখা সেই গান?
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সঙ্গে মিলবো কি সত্ত্বে?
বাংলাদেশের বাস্তবতাটাও ঠিক এমন। সুতরাং হ্যা, আমাদের রাজারাই এক সময় ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে এই মেম্বারদের দুর্নীতি করার রাস্তা খুলে দিয়েছিলো। এবং এখন ওই রাস্তা অবলম্বন করেই এই মেম্বাররা ত্রাণের চাল চুরি করে খাচ্ছে। জ্বি হ্যা, এই মুহূর্তে যদি আমাদের রাজারা মেম্বারদের চাল চুরি করার নির্দেশনা সরাসরি নাও দিয়ে থাকে, অনেক আগেই এই চুরির রাস্তা সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য দায়ী আমাদের রাজারাই। জ্বি হ্যা, এই মুহূর্তে যদি আমাদের রাজারা পুলিশদের ঘুষ খেয়ে চোদ্দগ্রামের রহিমকে তার প্রেমিকার সাথে দেখা করার উদ্দেশে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়ার নির্দশনা সরাসরি নাও দিয়ে থাকে, এক সময় নির্বাচনে ভোট কারচুপি করার স্বার্থে ওই পুলিশ অফিসারকে এইরকম ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য দায়ী এই রাজারাই। সব রাজতন্ত্রেই এই একই সমস্যা। চিনেও এই সমস্যা আছে, আমাদের দেশেতো আছেই।
কোনো সুশ্বাসিত দেশই একজন ভালো, সৎ রাজার উপর নির্ভরশীল না। তারা নির্ভর করে তাদের সরকার ব্যবস্থার উপর, তাদের গুড গভর্ণেন্সের উপর। তারা কেউই ব্যক্তি নির্ভর না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই।
আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে আপনি যদি টিন সার্টিফিকেট বের করতে যেতেন তাহলে রাজস্ব ভবনে গিয়ে বিভিন্ন মানুষকে ঘুষ দেওয়া লাগতো। ঘুষ দেওয়া একদম দরজার সামনে বসা চাচাকে দিয়ে শুরু হইতো। এরপর সরকার ই-টিনের ব্যবস্থা চালু করলো। আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইনে আপনার সব তথ্য দিবেন, এবং অনলাইনের মাধ্যমেই আপনার ই-টিন প্রিন্ট করে নিবেন। কাউকে দুই টাকা ঘুষও দেওয়া লাগবে না। এমন কিন্তু না যে রাজস্বভবনের কারো ঘুষ খাওয়ার প্রবণতা কমে গেসে। তাদেরকে সিস্টেম দ্বারা আটকায়ে দেওয়া হইসে। এটাই হচ্ছে ব্যক্তি নির্ভর না হয়ে সিস্টেম নির্ভর হওয়ার উদাহরন।
ইদানিং কানাডার সরকার তাদের জনগণকে অনেক ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এরপর দেখলাম আমাদের দেশের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কানাডার সরকারকে সাধুবাদ না জানিয়ে একক ভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, জাস্টিন ট্রুডোকে সাধুবাদ জানিয়েছে। আসলে কৃতিত্ত্বটা কিন্তু ওনার একার না। কৃতিত্ত্বটা কানাডার সরকারের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের রাজা হতে পারে, উনি ওই দেশের রাজা না। ওনার পক্ষে এককভাবে বেশিরভাগ জিনিস করাই অসম্ভব। এবং এই শ্বাসন ব্যবস্থার কারনেই ওরা আমাদের চেয়ে ভালো আছে। এই কারনেই ওদের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার কম।
সমস্যাটা এখানেই, আপনারা এখনো একজন ন্যায়পরায়নশীল, সৎ রাজার খোঁজে আছেন। আপনারা এখনো একজন ভালো রাজা চান। যেইদিন রাজতন্ত্রের প্রথার বিলুপ্তি চাবেন, যেইদিন এই প্রথাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিতে চাবেন, ওইদিন দেশের উন্নয়ন হবে।
ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।
শামস ইশতিয়াক রাহমান